যশোর ও মাগুরার দুটি উপজেলার আঞ্চলিক সড়ক হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে আছে একসময়ের জমজমাট ‘শের শাহ সড়ক’। তবে ঐতিহ্যের কথা জানেন না এলাকার বেশির ভাগ মানুষ। এমনকি সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছেও নেই যথেষ্ট তথ্য।
‘সড়ক এ আজম’ বা ‘শের শাহ সড়ক’। ২৫০০ কিলোমিটারের এই সড়ক যুক্ত করেছিল উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম অংশকে।
শুরি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শের শাহ্র শাসনামলে (খ্রিষ্টাব্দ ১৫৪১-১৫৪৫) প্রাচীন সড়কটির সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে নাম দেয়া হয় ‘সড়ক এ আজম’। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে সোনারগাঁও হয়ে যশোর জেলার উপর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, দিল্লি ও পাকিস্তানের পেশোয়ার হয়ে এই সড়ক বিস্তৃত ছিল আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত।
ব্রিটিশ শাসনামলে সেনা চলাচল এবং ডাক বিভাগের উন্নতির উদ্দেশ্যে সড়কটির সংস্কার করে কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত অংশের নাম দেয়া হয় ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড’।
তবে সময়ের আবর্তে বাংলাদেশ অংশে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহাসিক সেই ‘শের শাহ সড়ক’। ছয় শতাব্দীর পুরোনো সড়কটি বাংলাদেশ অংশে অস্তিত্ব সংকটে পড়লেও দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে তা ব্যবহৃত হচ্ছে এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হিসেবে।
যশোর ও মাগুরার দুটি উপজেলার আঞ্চলিক সড়ক হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে আছে এক সময়ের জমজমাট ‘শের শাহ সড়ক’। তবে ঐতিহ্যের কথা জানেন না এলাকার বেশির ভাগ মানুষ। এমনকি সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছেও নেই যথেষ্ট তথ্য।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার প্রবেশমুখেই দেখা যায় নব্বইয়ের দশকের একটি নামফলক। ইট-সিমেন্টের ফলকটি অনেকটাই এখন অস্পষ্ট। এর পাশের মাইলফলকে ছোট করে ‘শের শাহ সড়ক’ নামটি চোখে পড়ে। সরকারি নথিপত্রে উল্লিখিত এই ‘শের শাহ সড়ক’ই প্রাচীন আমলের ‘সড়ক এ আজম’।
বাঘারপাড়ায় শের শাহ সড়কের বিবর্ণ নামফলক
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাঘারপাড়া থেকে মাগুরার শালিখা, মহম্মদপুর হয়ে ফরিদপুর পর্যন্ত শের শাহ সড়কের সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে কেবল যশোরের বাঘারপাড়া ও মাগুরার শালিখার একাংশে সড়কটি পূর্ব নামে পরিচিত।
কী বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা
বাঘারপাড়ার আজমপুর এলাকার বর্ষীয়ান আব্দুল হামিদ নিউজবাংলাকে জানান, গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকেও এটি ইট বিছানো রাস্তা ছিল।
তিনি বলেন, ‘তখন আশপাশে আর কোনো ইটের রাস্তা দেখিনি। এরপর কত বড় বড় রাস্তা হইছে, কিন্তু এইটায় পিচ ঢালাই হইছে কয়েক বছর আগে।’
আরেক বর্ষীয়ান কামরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাধীনতার পরেও এই রাস্তা ব্যবহার করে আমরা ঢাকা গেছি। পরে অন্য বড় বড় রাস্তা হওয়ায় এইটা দিয়ে এখন আর যাওয়া হয় না। এ রাস্তা দিয়ে এখন আর তেমন গাড়িঘোড়াও চলে না। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী এহসান জুয়েলের বাড়ি বাঘারপাড়ায়। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাস্তার নামফলকে শের শাহ সড়ক দেখেছি। তবে আমরা এই রাস্তাকে নারিকেলবাড়িয়া-বুনোগাতি সড়ক বলি। ’
ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদ
এই অঞ্চলের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অংশ সড়ক ই আজমের বিলীন হওয়া ঠেকাতে উদ্যোগ চান ঐতিহ্য রক্ষা কর্মীরা। যশোরের সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য জিল্লুর রহমান ভিটু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছোটবেলায় গ্রামে যাওয়ার সময় সড়কটি দেখতাম। তখন ইতিহাসের বইয়ের পাতার সাথে এটি মেলাতাম। ভালো লাগত, কিন্তু এখন গ্রামে যাওয়ার পথে নামফলকটি চোখে পড়ে না। অনেকটা হারিয়েই গেছে শের শাহ সড়কের ইতিহাস।’
তিনি বলেন, ‘সড়কটি রক্ষা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। ইতিহাসবিদদের এগিয়ে আসতে হবে প্রথম। তাদের সাথে আমরাও থাকব। ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা না গেলে তা দেশ ও জাতির জন্য কখনোই মঙ্গল বয়ে আনবে না।’
যশোরের সমাজকর্মী ও রাজনীতিক নাজিমউদ্দিন বলেন, ‘যশোরের পশ্চিমাংশের সড়কটিকে আমরা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড হিসেবে চিনি, যদিও আজ তা আর কাগজেকলমেও নেই। শুধু বাঘারপাড়ার ওই অংশটুকুতেই শের শাহর নামে আছে। এই ঐতিহ্য অবশ্যই রক্ষা করা দরকার।’
যশোর সরকারি এমএম কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সড়কটি কলকাতা থেকে বেনাপোলে এসে শেষ হয়েছে। এরপর আর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তবে বাঘারপাড়ার কিছু অংশে এটি আছে। আমি মনে করি, সড়কটির ইতিহাস ও ঐতিহ্য আমাদের রক্ষা করা উচিত। তবে এটি আমার বা আমাদের কারোরই একার পক্ষে সম্ভব নয়। সরকার যদি চায়, তাহলেই কেবল এটা সম্ভব।’
যা বলছে কর্তৃপক্ষ
বাঘারপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ভিক্টোরিয়া পারভীন সাথী বলেন, ‘সড়কটি রক্ষার বিষয় নিয়ে আমিও ভাবছি। সবার সহযোগিতা পেলে এটি করা সম্ভব। সড়কটির উন্নয়নে প্রয়োজনে উপজেলার পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে।’
বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম মোয়াজ্জেম হোসেনের। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি ইতিহাসের আলোকে বলতে পারছি না। আমাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই। যেহেতু এটি অনেক পুরোনো একটি বিষয়, আমাদের ম্যাপ দেখতে হবে। যদি সেখানে কিছু পাওয়া যায়।’
সড়কটির বর্তমান অবস্থা ও নামফলকের বিষয়ে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘কাগজপত্র না দেখে আমি কিছুই বলতে পারব না। যেহেতু সড়ক ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হয়েছে, সেহেতু অনেক সড়ক নির্মাণ হয়েছে এবং হচ্ছে। সেখানে এ বিষয়টি আসেনি।’
অন্যদিকে, সড়কটির তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মির্জা মো. ইফতেখার আলী বলেন, ‘সড়কটি এলজিইডির তত্ত্বাবধানে আসার পর সাবেক কর্মকর্তারা ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্য দুটি নামফলক স্থাপন করেছিলেন। সেগুলো এখনও আছে। তবে দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে তা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। আসছে বাজেটে ইতিহাস ও ঐতিহ্যর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আরও দুটি নামফলক স্থাপনের ব্যাপারে আমরা ভাবছি। সেগুলো অনুমোদন পেলে সড়কটির আসল ইতিহাস আমরা নামফলকে সংযুক্ত করে দেব। একই সঙ্গে সড়কটি সংস্কারের ব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়া হবে।’
সূত্র : বনি আমিন, নিউজবাংলা২৪ ডটকম